অধিকার সুরক্ষিত কিন্তু...

দীপংকর চন্দ

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কড়া নাড়ছে দোরগোড়ায়। প্রায় দু’বছর জরুরি আইন জারি থাকার পর গণতেন্ত্র ফিরতে উদগ্রীব জাতি ধীরে ধীরে মেতে উঠছে নির্বাচনী আমেজে। নতুন আকাঙ্ক্ষায় দিকে দিকে আবার উচ্চারিত হচ্ছে, ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’; কিংবা ‘দেখে শুনে বুঝে দেব’ জাতীয় বাক্যাংশ। কিন্তু চাইলেই ‘যাকে খুশি’ অথবা ‘দেখে শুনে বুঝে’ হলেও নিজেদের ভোটটা পছন্দসই প্রার্থীকে দেওয়ার অধিকার কি পুরোপুরিই রাখে এই প্রজাতন্ত্রের সব জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়? না, বাংলাদেশে অন্তত সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কাছে এখনো এই অধিকার প্রয়োগের বিশেষ ক্ষেত্রটি যথেষ্ঠ বিড়ম্বনায় পূর্ণ এবং জীবন-সম্পদ-মানসম্মান জলাঞ্জলি দেওয়ার আশঙ্কায় আকীর্ণ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে দেখা গেছে, নির্বাচন নিকটবর্তী হলেই ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটিতে যোগ হয় বিশেষ দ্যোতনা।

সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ অংশ প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের আগেই ভয়ভীতি প্রদর্শন করে ভোটদান থেকে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়কে বিরত রাখতে শুরু করে এক হীন তৎপরতা। নির্বাচনের আগে শুরু করা এই তৎপরতার রেশ নির্বাচনের দিনগুলোয় তো বটেই, আরো ঘৃণ্যভাবে তা বজায় থাকে নির্বাচন-উত্তর কৃষ্ণকালেও। পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাকে বিবেচনায় নিয়ে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় প্রদত্ত বিভিন্ন জবানবন্দিকে অগ্রাহ্য করে শুধু প্রজাতন্ত্রের গ্রহণযোগ্য পত্রপত্রিকাগুলোর সংবাদ স্তম্ভে দৃষ্টি রাখলেও প্রাক্-নির্বাচন ও নির্বাচন-উত্তর সংখ্যালঘু নিপীড়নের চিত্র অনুধাবনে শিউরে ওঠার কথা যে কোনো মানবিক সত্তার। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ অংশের নির্বাচনী আক্রোশের আগুনে কত ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রাণ যে দগ্ধ হয়, কত লুণ্ঠন, কত ধর্ষণ, কত সম্পদ জবরদখলের ঘটনা যে সংঘটিত হয়, একটু সচেতন হলেই পত্রিকাসূত্রে সেসবের কিয়দংশের বিবরণ জানা যায় খুব সহজেই। কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি কেন এই আক্রোশ? বিশেষত নির্বাচনের দিনগুলোয় ‘কি বিশেষ দোষে’ দোষী করার প্রেক্ষিতে হানাহানির বলিকাঠে প্রতিবারই দাঁড়াতে হয় তাদের?

দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত একটি ধারণা যে, প্রতিটি নির্বাচনেই সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল কিংবা সেই দল সমর্থিত ব্যক্তির পক্ষে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। সুতরাং এই ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে যদি কোনো উপায়ে সংবিধান প্রদত্ত অধিকারটি প্রয়োগ করা থেকে বিরত রাখা যায়, তবে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া হয়তোবা কষ্টসাধ্য ব্যাপারে পরিণত হবে। আপাত অর্থে এ ধরনের ভাবনা থেকেই সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি পৈশাচিক আক্রোশে মেতে ওঠে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের বিশেষ অংশটি। অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বাধাহীনভাবে, নিশ্চিন্তে ভোটদানের অধিকার ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের জন্যই বিশেষভাবে সুরক্ষিত। প্রজাতন্ত্রের যে কোনো নাগরিক রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার অনুযায়ী তার ভোট দেখে শুনে বুঝে নিজ মতানুসারে যে কোনো প্রার্থীকেই দেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন। সেই অধিকারবলে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল কিংবা সেই দল মনোনীত প্রার্থীকে যদি কোনো ব্যক্তি, কোনো জনগোষ্ঠী অথবা বিশেষ কোনো সম্প্রদায় যদি বিশেষ কিছু বিবেচনায় প্রাধান্যও দেয়, তাহলে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র আপত্তি তোলা তো উচিতই নয় কারো, উচিত নয় সেই ভোটদানের বিষয়কে কেন্দ্র করে সহিংস কোনো ঘটনার জন্ম দেওয়া। যদিও নিশ্চিতভাবেই এ কথা বলা যায়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সব ভোট কখনোই একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষে যায় না, অনেক সংখ্যালঘুপ্রধান অঞ্চলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অনেক প্রার্থীই নির্বাচিত হন শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটের ওপর নির্ভর করেই। তবু তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট কেবল একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষেই প্রদান করা হয়, তবে এ প্রশ্ন তো সঙ্গে সঙ্গেই উঠে আসা উচিত, সেই ভোট প্রদানের পেছনে কী কারণ বিদ্যমান?

সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের যে কোনো বিশেষ অংশ, যে কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভোট তো নিশ্চিত করতেই পারেন তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিপত্রে, রাজনৈতিক আচার-আচরণ-কর্মসূচিতে ধনাত্মক পরিবর্তন আনার মধ্য দিয়ে। সেই পরিবর্তন যদি আনাই হয়, তবে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় যে ভোটদানের ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলকেই বিবেচনায় আনবে, সে কথা শুধু নিশ্চিতই নয়, যাপিত জীবনবোধের বাস্তবতায় আন্তরিকও বটে।

সমকাল, ২৫ ডিসেম্বর, ২০০৮

No comments:

Post a Comment